ভূমিকা
"আমার তো লেখার মতো প্রতিভা নেই," "কী লিখব, কিছুই তো মাথায় আসে না," "আমার লেখা কে-ই বা পড়বে?"—লেখালেখি শুরু করার আগে এই ধরনের চিন্তা কি আপনার মনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়? আমাদের অনেকের মধ্যেই একজন গল্পকার বা লেখক লুকিয়ে থাকে, কিন্তু নিখুঁত হওয়ার চাপ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে সেই কণ্ঠস্বরটি কখনোই প্রকাশিত হতে পারে না। কিন্তু যদি বলি, লেখালেখি শুরু করার জন্য আপনার প্রতিভাবান বা পেশাদার হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই? প্রয়োজন শুধু একটি খাতা, একটি কলম এবং দশ মিনিট সময়। আজ আমরা "ফ্রিরাইটিং" নামক একটি অসাধারণ এবং সহজ কৌশল নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনার ভেতরের লেখককে জাগিয়ে তুলবে এবং লেখালেখির ভয়কে চিরতরে দূর করে দেবে।
ফ্রিরাইটিং (Freewriting) কী?
ফ্রিরাইটিং হলো একটি সৃজনশীল লেখার অনুশীলন, যার মূল নিয়মটি হলো—কলম না থামিয়ে একটানা একটি নির্দিষ্ট সময় (যেমন: ১০ বা ১৫ মিনিট) লিখে যাওয়া।
নিয়মাবলী:
1. একটি টাইমার সেট করুন (৫-১০ মিনিট দিয়ে শুরু করুন)।
2. এই সময়ের মধ্যে আপনার কলম বা কিবোর্ড একবারের জন্যও থামানো যাবে না।
3. বানান, ব্যাকরণ, বা লেখাটি ভালো হচ্ছে কিনা—এইসব নিয়ে абсолютноই ভাববেন না।
4. মাথায় কিছু না এলে, "আমি কী লিখব জানি না" বা "আমার মাথায় কিছু আসছে না" —এই বাক্যটিই বারবার লিখতে থাকুন, যতক্ষণ না নতুন কোনো চিন্তা আসছে।
5. টাইমার বাজার আগে লেখা থামাবেন না।
কেন ফ্রিরাইটিং এত কার্যকরী?
১. এটি আপনার ভেতরের সমালোচককে চুপ করিয়ে দেয় (It Silences Your Inner Critic)
আমাদের লেখা শুরু করতে না পারার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমাদের ভেতরের সমালোচক সত্তাটি, যে প্রতিটি শব্দ লেখার আগেই বিচার করতে শুরু করে। ফ্রিরাইটিংয়ের "না-থামা" নিয়মটি এই সমালোচককে ভাবার কোনো সুযোগই দেয় না। আপনি শুধু লিখে যান, যা আপনার সৃজনশীলতার প্রবাহকে মুক্ত করে দেয়।
২. এটি "রাইটার্স ব্লক" ভাঙার সেরা ঔষধ (It's the Best Cure for Writer's Block)
মাথায় কিছু না আসা বা "রাইটার্স ব্লক" হলো প্রতিটি লেখকের দুঃস্বপ্ন। ফ্রিরাইটিং এই অচলাবস্থা ভাঙতে সাহায্য করে। যখন আপনি কোনো কিছু না ভেবেই লিখতে থাকেন, তখন আপনার অবচেতন মন থেকে এমন সব ধারণা এবং সংযোগ বেরিয়ে আসে যা আপনি হয়তো কল্পনাও করেননি।
৩. এটি চিন্তাভাবনাকে স্পষ্ট করে (It Clarifies Your Thoughts)
ফ্রিরাইটিং শুধু সৃজনশীল লেখার জন্যই নয়, এটি আপনার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা এবং আবেগগুলোকে গুছিয়ে তোলারও একটি চমৎকার উপায়। যখন আপনি আপনার মাথার ভেতরের এলোমেলো চিন্তাগুলোকে কোনো ফিল্টার ছাড়াই কাগজে নামিয়ে আনেন, তখন আপনি সমস্যা বা অনুভূতিগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পান।
৪. এটি লেখালেখিকে একটি অভ্যাসে পরিণত করে (It Makes Writing a Habit)
যেকোনো দক্ষতার মতোই, লেখালেখিও অনুশীলনের মাধ্যমে উন্নত হয়। প্রতিদিন মাত্র ১০ মিনিটের ফ্রিরাইটিং অনুশীলন আপনার মস্তিষ্কের "লেখালেখির পেশী"-কে শক্তিশালী করে তোলে। এটি লেখালেখিকে একটি ভীতিকর কাজ থেকে একটি সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যাসে পরিণত করে।
কীভাবে ফ্রিরাইটিং শুরু করবেন? (কিছু আইডিয়া)
শুরু করার জন্য আপনি কিছু প্রম্পট বা নির্দেশক ব্যবহার করতে পারেন:
একটি শব্দ দিয়ে শুরু করুন: যেমন—"জানালা," "বৃষ্টি," বা "পথ"। এই শব্দটি দিয়ে আপনার মাথায় যা আসছে, তাই লিখতে শুরু করুন।
একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করুন: "যদি আমি অদৃশ্য হতে পারতাম..." বা "দশ বছর পর আমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাই?"
আপনার চারপাশ বর্ণনা করুন: আপনি এখন যেখানে বসে আছেন, সেখানে কী কী দেখতে, শুনতে বা অনুভব করতে পারছেন, তা লিখুন।
উপসংহার
লেখালেখি একটি উপহার, যা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। এটি নিজেকে প্রকাশ করার, কল্পনাকে ফ্লাইট দেওয়ার এবং আমাদের চারপাশের জগৎকে আরও ভালোভাবে বোঝার একটি মাধ্যম। ফ্রিরাইটিং হলো সেই উপহারের বাক্সটি খোলার চাবি। আপনার লেখাটি নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু শুরু করার সাহস। তাহলে আর দেরি কেন? একটি খাতা আর কলম নিয়ে বসে পড়ুন, ১০ মিনিটের জন্য টাইমার সেট করুন, আর দেখুন আপনার ভেতর থেকে কী বেরিয়ে আসে। আপনি হয়তো নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা লেখককে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাবেন।
